ক্লাস সেভেন পাশ আলি স্রেফ কাঠ দিয়েই বানিয়ে ফেলেন বিশালাকার জাহাজ, কেন্দ্রের তরফে মিলে পদ্মশ্রীও

মাত্র সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করা মানিকফন নিজের জীবনে করেছে এই মহান কাজগুলো

কথায় রয়েছে যে যদি কোনো কাজ করার মন থেকে যদি ইচ্ছা থাকে তবে তার উপায় ঠিক বেরিয়ে যায়। তখন সেই কাজ পূরণ হওয়ার রাস্তায় কোনো কিছু বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। সে আপনি শিক্ষিত হন বা অশিক্ষিত হন, গরিব হন বা না হন। এই কথাটিকেই বাস্তবে প্রমান করে দেখিয়েছেন আলি মানিকফন ওরফে মুরাইদুগানদুয়ার আলি মানিকফন। লক্ষদ্বীপের এই বাসিন্দা ২০২১ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কার দ্বারা সম্মানিত হয়েছেন। এনার শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা যদি বলা হয় তবে আলি মানিকফন ওরফে মুরাইদুগানদুয়ার আলি মানিকফন মাত্র সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। তিনি পুঁথিগত পড়াশোনার উপর বিশ্বাস করতেন না। আলি মানিকফন মনে করতেন মানুষ যদি পরিবেশের নিকটে থাকে সেখান থেকে মানুষ অনেক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে।

Manikfon

মানিকফনের বাবা তাকে পড়াশোনা করার জন্য কুন্নুরে পাঠিয়েছিলেন কিন্তু এমন চিন্তাধারা থাকার জন্য মানিকফন মাঝপথে তার পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। মানিকফন এক সাক্ষাৎকারে জানান যে তার দাদুর হাত ধরেই প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর পরিচয় পর্ব শুরু হয়েছিল। তার দাদু একজন মৎসজীবি ছিলেন। দাদুর সঙ্গেই মাছ ধরতে যেতেন মানিকফন। সেখান থেকেই ভিন্ন রকমের মাছ, জাহাজ, সামুদ্রিক প্রাণী, তারা দেখে দিক নির্ধারণ করা শিখেছিলেন তিনি। এমনকি সমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার পর বিভিন্ন ধরনের ভাষাও শিখে ফেলেছিলেন তিনি। যেমন-, হিন্দি, মালয়ালম, আরবি, ফরাসি, লাতিন, রাশিয়ান, জার্মান, সিংহলি, পার্সি, সংস্কৃত, তামিল ও উর্দু ইত্যাদি।

Ship

এরপর মানিকফন আবহাওয়া দফতরের অনুরোধে তিনি লাইটহাউসে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করেছেন। এছাড়া তিনি আরো বিভিন্ন পেশায় কাজ করেছেন যেমন শিক্ষকের পেশায়, আবার কখনো কেরানির পদে।
এছাড়া মানিকফন হাইড্রোজেন বেলুন উড়িয়ে আবহাওয়া কেমন থাকবে তা-ও নির্ধারণ করতে পারতেন। সমুদ্র মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের রসায়ানাগারে সমুদ্র জীববিজ্ঞানী সান্থাপ্পন জোনসের অধীনে কাজ করার সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি। এমনকি মানিকফনের প্রতিভা দেখে জোনস অভিভূত হয়েছিলেন। জোনস তাঁর ছাত্রের জীবনে এক নতুন দিক খুলে দিয়েছিলেন। ১৯৮১ সালে লক্ষদ্বীপের মানিকফনের সঙ্গে জোনস পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন টিম সেভেরিন নামের এক আইরিশ পর্যটকের। মানিকফনের গুণ সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন। জাহাজ তৈরির কাজেও যে তিনি পটু ছিলেন তা জানতেন টিম। তাও দুজন মিলে একটি জাহাজ বানানোর পরিকল্পনাও করেছিলেন।

Agreecuture

এরপর জাহাজ যখন সম্পূর্ন তৈরি হয়ে গেছিল তখন এই জাহাজের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সোহার’। টিম এই জাহাজ নিয়ে ওমান থেকে ৯,৬০০ কিমি যাত্রা করে চিন পৌঁছেছিলেন। ‘সোহার’ তৈরি করতে কোনও রকম ধাতুর ব্যবহার করেননি মানিকফন। বর্তমানে জাহাজটি ওমানের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ম্যারিটাইম হিস্ট্রিতে রাখা রয়েছে। তবে এতো ট্যালেন্টেড ব্যক্তি মানিকফন বর্তমানে কেরলের কোজিকোড় জেলার ওলাভান্না শহরে খুব সাধারণ ভাবে জীবনযাপন করেন এবং খাবার রান্না করা থেকে শুরু করে মাছ ধরা সবকিছুই একা হাতে সামলান তিনি। এছাড়া সৌরশক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ তৈরি করে নিজের বাড়িতে সেই সংযোগ স্থাপন ও নিজের জন্য ব্যাটারি চালিত সাইকেল তৈরি করেছেন মানিকফন। আর সাথে ১৫ একরের অনুর্বর জমিতে চাষ করে চাষযোগ্য জমিতে পরিণত করেছেন।

Sea

তবে এর আগে গত ছয় দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে বেড়িয়েছেন তিনি। আর এই প্রকৃতি বা বিশ্বকে তিনি শিক্ষা লাভের জন্য আদর্শ জিনিস বলে মনে করেন। আর মানিকফনের ব্যক্তিগত জীবনের কথা বলতে গেলে তার ৪ টি সন্তান রয়েছে। নিজের সন্তানদের মানিকফন নিজের আদর্শতেই বড় করে তুলেছেন। মানিকফনের শিক্ষকতার পেশায় রয়েছে এবং ছেলে নৌবাহিনীতে কর্মরত। আর তার ৪ সন্তানও মানিকফনের মতো পূঁথিগত বিদ্যায় বিশ্বাস করেন না।

Ship